আমার বাংলা আমার ভাষা

বাংলা আমার চেতনা (ফেব্রুয়ারী ২০১৬)

জসিম উদ্দিন জয়
  • ৬৮
বাঙ্গালি হাজার বছরের সংস্কৃতির অধিকারী । আমরা বাঙালি জাতি যে ভাষায় আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করে সেটিই বাংলা ভাষা। ভাষাভাসী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর ৪থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বর্তমানে বাংলাভাষা ভাষী জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটির বেশী । পৃথিবীতে ভাষা আছে প্রায় ৩৫০০ ( সারে তিন হাজারেরও বেশী ) বাংলা ভাষাভাষীরা থাকে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা, বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, এবং ভারতের ত্রিপুরা, উড়িষ্যার, বিহার ও আসামের কিছু অংশে। তবে এখন প্রবাসী বাংলাদেশী ও প্রবাসী ভারতীয় বাঙালীদের কল্যাণে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকে। ভাষা নিয়ত পরিববর্তনশীল । প্রতিটি মুহুর্তে ভাষা একটু করে পরিবর্তিত হয়ে আসছে । প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি ভাষাভাষী লোকজন তাদের ভাষার কঠিন শব্দটিকে পাল্টে সহজ করে নিচ্ছে, ছোট করে নিচ্ছে, আবার প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে নতুন নতুন শব্দ গ্রহন করছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে নানা কৌশল প্রয়োগ করে নতুন নতুন শব্দও তৈরি করছে। এমনকি পুরোনো কোনো শব্দ নতুন অর্থে ব্যবহার করেও শব্দটির নতুন অর্থদ্যোতবতা তৈরি করে নতুন শব্দ তৈরি করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার এই কৌশলকে নুতনর্ প্রাপ্ত বহুল ব্যবহুত কিছু শব্দ হচ্ছে কঠিন ও চরম ।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি থেকে আমরা পিছিয়ে নেই । বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করার দাবিতে পাঁচ কোটি মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বের সব দেশের সরকার-প্রধানকে পাঠানো আবেদনটি জাতিসংঘে হয়ত পৌঁছেছে এবং জাতিসংঘের আমলারা পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়ে নথি চালাচালি করছেন।
১৯৮০ সালে আরবিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পর ৩২ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। এর আগে ১৯৭৩-এ চীনা এবং ১৯৬৮-এ রুশ ১৯৪৮-এ স্পেনিশ এবং শুরু থেকেই ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ দাপ্তরিক ভাষা।
পাঁচ কোটি মানুষের গণদাবিকে স্বাগত জানিয়ে একটিই সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল– জাতিসংঘে সপ্তম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালু হয়ে গেলে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে সাধারণ অধিবেশনে যোগদানকারীকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে সহজে বোঝার স্বার্থে এই বাংলা না আবার ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে অনুবাদ করে দিতে হয়।
রাষ্ট্রভাষা আজ আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষার সাফল্য অর্জন করেছি। বাংলা সাংবিধানিকভাবেই বাংলাভাষা, এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নথিতে ও পত্রে বাংলা ব্যবহারে বাধ্যতা সৃষ্টিকারী আইনও প্রণয়ন করা হয়।
অতি সম্প্রতি বিকৃত বাংলা ব্যবহার রোধে বিজ্ঞ উচ্চ আদালত অনুগ্রহ করে রুল জারি করেছে। বিকৃত বাংলা ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হতে যাচ্ছে।
বাংলা এমনি একটি ভাষা যার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে বহুবার। সবার জানা আছে, দেশ বিভাগের পর 'পাকিস্তান' নামে নবীন রাষ্ট্রের জন্ম হবার মাত্র ৫ বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে, পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চারজন শহীদ হন। শুধু ভাষার দাবিতে প্রাণদানের নজির সারা পৃথিবীতেই বিরল।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তার অন্যতম কারণও এ দেশের মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি। এর ফলেই পরবর্তীকালে এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিবসটিকে টঘঊঝঈঙ থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই 'মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের অর্জন পৃথিবীর ৬,৯১২ টি ভাষাগোষ্ঠীকে শিখিয়েছে মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ভালবাসা।
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের পর গত ষাট বছরে বাংলাতে কোন মূল্য সংযোজন করতে পারিনি। ভাষার জন্য মাতমই আর উৎসবই হোক ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে গেলে আমরা পুরনো অবস্থানে ফিরে আসি। ইংরেজির নান্দীপাঠ করি, হিন্দি গানের কলি আওরাই, আরবি দোয়া পাঠ করি। ইদানিং একটা বিষয় খুব লক্ষ করি, বেশ কিছু বাঙালি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালির এই আত্মসন্মান বোধের অভাব আজকাল খুবই চোখে পড়ার মত। আমরা সব জায়গায় বাংলা বলি না, ছেলেমেয়ে বাংলা না শিখলে আমরা গর্ববোধ করি। একটু টাকা পয়সা হলেই বাবা মা তাদের সন্তানকে ভাল শিক্ষার নাম করে পাঠিয়ে দেন ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে। তাহলে বাংলা মাধ্যমে কি ভাল শিক্ষা দেয়া হয় না? নাকি ভাল শিক্ষা শুধু ইংরেজিতেই হতে পারে।

আমরা এক অদ্ভুত কারণে সবসময় পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে রই, পূর্বের দিকে নজর খুব একটা দেই না। পূর্বের দিকে নজর দিলেই দেখতে পেতাম ২০০ বছর গোলামির ইতিহাস, আর বাংলা ভাষার শৌর্যবীর্য। আজ আমরা সেই গোলামির উপঢৌকন নিয়ে কতই না মাতামাতি করি কিন্তু ভুলে যাই বাঙালি হবার মূল শিকড় আমাদের বাংলা ভাষা। যে ভাষা আমাদের জাতীয়তার পরিচয় বহন করে, তাকে ভুলে গেলে আমাদের জন্ম পরিচয় কি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না?


আর আজ কিনা আমরাই গোলামি করছি অন্য ভাষার। শুধু এ দেশই নয়, বাংলা ভাষার দাবিতে মানুষ প্রাণ দিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও, এ তথ্যটি হয়ত অনেকেরই জানা নেই। ভারতে আসামের কাছাড় অঞ্চলের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা কিন্তু রাজ্য সরকার সেই ভাষার কোন অধিকার দেয়নি বলে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়েছিল কাছাড়ের শিলচর শহরে। ১ মে, ১৯৬১ সালে সেখানেও মিছিলের ওপর দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, মৃত্যু হয় ১১ জন মানুষের। এই চরম শোকাবহ ও লজ্জাজনক ঘটনা বেশি প্রচারিত হয়নি বরং চাপা দেবারই চেষ্টা হয়েছে।

অনেকেই এমন মত পোষণ করেন যে, উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে স্থান করে নিতে হলে ইংরেজি ভাষার বিকল্প নেই। তাদের জন্য বলতে চাই, চীনে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোকের ভাষা ম্যান্ডারিজ, সুতরাং অধিবাসীদের মধ্যে ভাষার ব্যবধান নেই বললেই চলে, কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় সে দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। তাই বলে কি জাতি হিসেবে তারা পিছিয়ে আছে? ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষা সবদিক থেকে তারা ইংরেজি ভাষাভাষীদের সমকাতারে বললে বরং চীনকেই কিছুটা ছোট করা হবে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, আর ইতিহাস ঐতিহ্যের দিক থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা। এই ভাষার মানুষ কি কখনও হীনমন্যতায় ভুগতে পারে?

আগেই বলেছি, এক অদ্ভুত কারণে আমরা পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনও পূর্বে তাকাই না। আমাদের পূর্বের দেশগুলো কি করে, সে সম্বন্ধে আমরা খুব কমই জানি। আজকের চীন, কোরিয়া বা মালয়েশিয়া, এদের ভাষা নিয়ে গর্ব দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। এমনকি জাপান, যদিও কারিগরি বিষয়ে এত উন্নতি করেছে যে দেশ, সেই দেশের বহুলোকই একবর্ণ ইংরেজি জানে না, ইংরেজি না জেনেও চ্যালেঞ্জ করে তারা সবকিছুতেই উন্নত হয়েছে। তবে আমরা কি পারি না? আমরা কি এতই খারাপ, আমাদের ভাষা কি এতই দুর্বল? তা তো নয়। ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেন, বাংলা ভাষার এত ঐশ্বর্য, শুধু সংস্কৃত নয়, সব ভাষা থেকে আমরা শব্দ গ্রহণ করি, আমাদের ভাষার দরজা এখনও খোলা। আর ক্রিয়ার উপর বাংলাভাষার দখল অনেক বেশি, যে কোন ভাবই আমরা বাংলায় প্রকাশ করতে পারি। সেই ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব থাকবে না!

খুব কষ্ট পাই, যখন দেখি আমাদের দেশের নামি দামি ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার্থীরা বাংলাভাষার বিকৃতি ঘটিয়ে নিজের বাংলায় অপারগতা প্রকাশ করে লজ্জাবোধ করছে না কিংবা, যারা বিদেশে গিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে মাতৃভাষা ভুলে গেছে, বাঙালিদের সাথে মিশতে চায় না, বাংলা গান শোনে না,। বিদেশে গান এর তালে তালে চলে ক্লাস পার্টি । এমনকি প্রায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলোতে দেখা যায় । বিদেশী কালচার । হিন্দি গানের তালে তালে ক্লাস পার্টি, ইংরেজী নাচ । তাহলে আমাদের নতুন প্রজন্ম কোন পথে ? তাদের বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা কোন পথে ?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ruma akter বিশ্লেষনধর্মী লেখা ।
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
Shohel munna আপনার লেখাটি পড়লাম বেশ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা । ঠিক জায়গায় কথাগুলো বলেছেন । ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

১৮ নভেম্বর - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪